আগাম ফুলকপি চাষ


জমি তৈরি : মূল জমি চাষ দিয়ে বেশ ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। গোবর সার, কম্পোস্ট, খৈল, ছাই ইত্যাদি সারের অর্ধেক পরিমাণ ভূমি কর্ষণকালে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়।

চারা রোপণ : ৬-৭টি পাতাবিশিষ্ট চারা রোপণ করতে হয়। আগাম ফসলের জন্য ৬০ সেন্টিমিটার পর পর সারিতে ৪০-৫০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে মধ্য ফসলের জন্য ৬০ সেন্টিমিটার পর পর সারিতে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করা যেতে পারে। চারা রোপণের উপযুক্ত সময় বিকাল। রোপণের পর চারার গোড়ায় ঝাঝরি দিয়ে পানি সেচ দেয়া দরকার। পরদিন সকালে কলার খোল, কচুরিপানা প্রভৃতি দ্বারা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হয়। এ ছায়া বিকালে সরিয়ে চারায় রাতে শিশির পড়ার সুযোগ দিতে হয়। তিন-চারদিন পর্যন্ত এ ব্যবস্থা এবং সকাল-বিকাল পানি সেচ দিতে হয়। তারপর ছায়া সরিয়ে ফেলা হয় এবং পানি সেচ কেবল বিকালে দিলেই চলে। মাটিতে জো এলে গাছের সারির মধ্যবর্তী স্থানে গাছের গোড়ার মাটি উঠিয়ে, ভেলি করে দেয়া দরকার। রোপণের প্রায় দু’মাসের মধ্যে গাছে ফুল দেখা দেয়। ফুল দেখা দেয়ার ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে ফুলকপি খাওয়ার উপযুক্ত হয়।

মাটি : আগাম ফসলের জন্য দোআঁশ এবং নাবি ফসলের জন্য ভারী মাটি উত্তম। এঁটেল দোআঁশ মাটিতে প্রচুর জৈব সার প্রয়োগ করে ভালো ফসল জন্মানো যায়।

সারের মাত্রা ও সার প্রয়োগ : ফুলকপি চাষের জন্য মাঝারি উর্বর মাটিতে হেক্টর প্রতি ৩০০-৩৫০ কেজি ইউরিয়া, ১৩০-১৫০ কেজি টিএসপি, ১৫০-২০০ কেজি এমপি এবং ৫-৭ টন গোবর সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এছাড়া অম্ল মাটি ৪০০-৭০০ কেজি, ডলোচুন এবং যথারীতি অনুসার (ঘাটতি মাটিতে) প্রয়োগ করতে হয়। জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর, সমুদয় টিএসপি ও অর্ধেক এমপি সার প্রয়োগ করতে হয়। বাকি অর্ধেক গোবর চারা রোপণের এক সপ্তাহ আগে মাদায় দিয়ে মিশিয়ে রাখতে হয়।
ইউরিয়া এবং বাকি অর্ধেক এমপি সার তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হয়। চারা লাগানোর ৮-১০ দিন পর প্রথম কিস্তি এবং চারা লাগানোর ৩০-৫০ দিন পর অবশিষ্ট সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা : ফসলের নিবিড় যত্ন যেমন আগাছা দমন, সার প্রয়োগ, পানি সেচ নিষ্কাশন এবং চটা ভেঙে দেয়া মাটি ঝুরঝুরে ও বায়ুর চলাচলের উপযোগী রাখা আবশ্যক। ফুলকপির রঙ সাদা রাখার জন্য কচি অবস্থা থেকে চারদিকের পাতা বেঁধে ঢেকে দিতে হয়। ফুল ঢেকে দেয়ার এ পদ্ধতিকে ব্ল্যানচিং বলে।

পোকা দমন : ফুলকপির বিভিন্ন পোকার মধ্যে জাবপোকা। পাতা ও ফুলের রস শোষণ করে। এফিডান সেভিন ৫% পোকা দমন করে। সেফস বা নেক্সিয়ন ও (০.৫%) ওষুধও ছিঁটানো যায়। অন্যান্য পোকার মধ্যে মাছি পোকা ও মখ উল্লেখযোগ্য। এদের দমনের জন্য ফলিখায়ন কিংবা সুমিথিয়ন প্রযোজ্য।

রোগ দমন : ফুলকপির রোগের মধ্যে ঢলে পড়া এবং মূলের গিট রোগ উল্লেখযোগ্য। এর আক্রমণে রোদের সময় গাছ পাতা ঢলে পড়ে। শিকড় ফুলে স্থানে স্থানে মোটা হয়। প্রতি ৫০ গ্যালন পানির সঙ্গে ২৩০ গ্রাম পরিমাণে ক্যালোমেল মিশিয়ে গাছে ছিঁটানো ফলপ্রদ। মূল গিট রোগ এক ধরনের নেমাটোড দ্বারা সৃষ্ট। এতে মূলে গিট দেখা দেয়। এর আক্রমণে ইথিলিয়ন ডাই-ব্রোমাইড দ্বারা মাঠে ফিউমিগেশন করার প্রয়োজন হয়। মাটিতে চুন প্রয়োগেও উপকার পাওয়া যায়।

অপুষ্টি রোগ : মলিবডেনামের অভাবে হুইপটেইল রোগ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত অম্লীয় মাটিতে এরূপ ঘটতে পারে। হেক্টর প্রতি ১.২ কেজি পরিমাণে সোডিয়াম কিংবা এমোনিয়াম বলিবডেট প্রয়োগে এ সমস্যা দূর করা যায়। বোরনের অভাবে বাদামি বর্ণের দাগ হয়। কখনো কখনো বিক্ষিপ্ত ফাঁপা কান্ডের সৃষ্টি হয়। অম্লীয় মাটিতে হেক্টর প্রতি ১২-১৫ কেজি পরিমাণে সাধারণ বোরাক্স সোডিয়াম টেট্রাবোরেট প্রয়োগে এ রোগ দমন করা যায়।

বোতামায়ন : বোতামায়ন রোগে ছোট আকারের গাছে অতি ছোট আকারে ফুল ধরে। নাইট্রোজেনের অভাবে কিংবা খাদ্য উপাদানের ঘাটতিতে এরূপ ঘটতে পারে। অনেক সময় ফুলকপি ক্ষুদ্র আকারের প্রাক-মঞ্জুবি উৎপাদন করে। এগুলো বিক্রির উপযুক্ত নয়।

বোতামায়নের কারণ ও প্রতিকার : এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হলো।
১. অকালে ফুলকপি গাছে প্রাক-মঞ্জুরি উৎপাদিত হওয়াই বোতামায়নের কারণ
২. আগাম জাতেই বোতামায়ন বেশি হয়
৩. ফুলকপির প্রাক-মঞ্জুরি উৎপাদন তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল
৪. আগাম জাতের গাছ নিম্ন তাপমাত্রায় উন্মোচিত হলে বোতামায়ন হয়
৫. বীজতলায় অনধিক ১০ সেন্টিমিটার উঁচু ও মাত্র কয়েকটি পাতাধারী গাছেও বোতাম উৎপাদিত হতে দেখা যায়
৬. চারা রোপণ করতে দেরি হলে কিংবা রোপণের পর কোনো কারণে চারার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হলে বোতামায়নের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।

প্রতিকার : বোতামায়নের সমস্যা দূর করতে হলে বর্ষজীবী বা আগাম জাতে আগাম মৌসুমে লাগাতে হয়। গাছ যাতে দ্রুত বাড়ে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়। বর্ষজীবী জাতের চারা এমনভাবে লাগাতে হয় যাতে তাপমাত্রা কমার আগেই আকারে বড় হয়ে যায়।

মখমলায়ন : ফুলকপির প্রাক-মঞ্জুরি ঢিলেঢালা হয়ে মখমলের মতো রূপ ধারণের নাম মখমলায়ন। এ অবস্থায় প্রাক-মঞ্জুরি কিছুটা ফেটে যায়, উপরিভাগ ঠাসা, দৃঢ় ও মসৃণ না হয়ে কিঞ্চিত নমনীয় ও উঁচু-নিচু হয়ে যায়। প্রাক-মঞ্জুরি থেকে সাদা ফুলকুড়ি হয়ে উপরের দিকে কিছুটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। প্রাক-মঞ্জুরি উৎপাদনের সময় তাপমাত্রার উঠানামা বেশি হলে এন অবস্থা সৃষ্টি হতে দেখা যায়।

ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ : ফুল ফোটা শুরু হওয়ার আগেই ফুলকপি বেশ দৃঢ় থাকা অবস্থায় তা সংগ্রহ করা উচিত। অন্যথায় কপি ফেটে যেতে পরে কিংবা রঙ খারাপ হয়ে যেতে পারে। ঠান্ডা গুদমে ৩২ ফা. তাপে এক মাস রাখা যায়। জমি থেকে তোলার প্রায় সপ্তাহখানেক আগে নেপথলিন এসেটিক এসিড ছিঁটিয়ে পরে ঠান্ডা পরিবেশে দেড় মাস পর্যন্ত ফুলকপি অবিকৃত রাখা যায়।

বীজ উৎপাদন : ফুলকপি খাওয়ার উপযোগী অবস্থায় গাছ মাটিসহ তুলে অন্যত্র রোপণ করলে বীজ উৎপন্ন হতে পারে।

ফুলকপির উন্নয়ন : বাংলাদেশে ফুলকপির জাত উন্নয়নের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকরা কিছু কিছু স্থানীয় জাতের চাষ করে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট রূপা নামে একটি জাতের উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ জমিতে ফুলকপির বর্ষজীবী আগাম জাতের চাষ হয়। এগুলো চাষে বোতায়মায়ন একটি বড় সমস্যা। প্রতি বছর এর দরুন কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আগাম জাতগুলোর গাছ প্রাক-মঞ্জুরি উৎপাদন করার আগে মাত্র কয়েকটি পাতা উৎপাদন করে, ফলে এগুলোর ফলন কম হয়। কোনো কোনো সময় আমদানিকৃত নাবী জাত দেরিতে লাগলে গাছ প্রাক-মঞ্জুরি উৎপাদন করতে পারে না, অথবা প্রাক-মঞ্জুরি বের হতে বা তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়, যার ফলে ফসল নষ্ট হয়।
উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে বাংলাদেশের ফুলকপির জাত উন্নয়নের উদ্দেশ্য নিম্নরূপ হওয়া উচিত।
ক. উৎকৃষ্ট গুণসম্পন্ন এবং উচ্চ ফলনশীল মাঝ মৌসুমী জাত উদ্ভাবন করা দরকার
খ. এমন বর্ষজীবী জাত বিমুক্ত করা যায় গাছ দ্রুত বাড়ে
গ. জাত এমন হয় যেন উচ্চ (৩০-৩৫০ সে.) তাপমাত্রায় গাছের বৃদ্ধি তেমন ব্যাহত না হয়
ঘ. শঙ্কর জাত উদ্ভাবন করা প্রয়োজন।
লেখক: উত্তম সরকার 
এগ্রোবাংলা ডটকম

Comments