ভিয়েতনামের হোয়ায়েট মাসল পাঙ্গাস

পাঙ্গাস মাছ চাষের নতুন সম্ভাবনা ভিয়েতনামের হোয়ায়েট মাসল পাঙ্গাস

মো. আব্দুর রহমান, বাকৃবি:
বাংলাদেশ নদীনালা, খালবিল ও হাওর-বাঁওড়ের দেশ। এসব জলাশয়ে এক সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, কিন্তু প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট নানা কারণে বর্তমানে এসব জলাশয়ে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। ষাটের দশকে দেশে মোট আহরিত মৎস্যের ৯০% আসত এসব উন্মুক্ত জলাশয় থেকে যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ৪০% এ। সে কারণে মাছের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ শুরু হয়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ হচ্ছে, তবে পাঙ্গাস ব্যাপকভাবে চাষকৃত মাছের একটি প্রজাতি।

বাংলাদেশে পাঙ্গাসের চাষ শুরু হয় প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় আগে। থাইল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা ‘থাই পাঙ্গাস’ দিয়েই এদেশে পাঙ্গাস চাষের যাত্রা শুরু। তখন থেকে ধীরে ধীরে এই মাছের চাষ অনবরত বেড়েছে। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় আড়াই থেকে তিন লক্ষ মেট্রিক টন থাই পাঙ্গাস উৎপাদন হয়। দিনকে দিন এই মাছের চাষ বাড়লেও বাড়েনি মাছের দাম। পক্ষান্তরে বহুলাংশেই বেড়েছে মাছের খাবার ও চাষের অন্যান্য সকল উপাদানের দাম। অপর পক্ষে অন্ত:প্রজননের কারণে আগের তুলনায় বৃদ্ধির হার গেছে কমে আর এফ.সি.আর. (Feed Conversion Ratio) গিয়েছে বেড়ে। ফলে শুরুতে থাই পাঙ্গাসের চাষ বেশ লাভজনক হলেও বর্তমানে লাভ খুবই কম, কখনোবা চাষীকে লোকসান গুনতে হয়। এছাড়াও চাষযোগ্য মাছের মধ্যে জাতীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে থাই পাঙ্গাস এক নম্বরে থাকলেও রপ্তানীতে একেবারে পিছিয়ে, রপ্তানী হয়ইনা বলতে গেলে। মাছের দাম কম হওয়ার এটিও একটি করণ।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এগিয়ে এসেছেন বেশকজন কৃষিবিদ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞানের কয়েকজন গ্রাজুয়েটের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মৎস্য হ্যাচারী স্বর্ণলতা এগ্রোফিশারিজ লিঃ ভিয়েতনাম থেকে নিয়ে এসেছে হোয়ায়েট মাসলযুক্ত পাঙ্গাস। ক্যাটালিস্ট ও ইনোভিশন কনসাল্টিং-এর উদ্যোগে ২০১১ সনে স্বর্ণলতা এই পাঙ্গসের মাতৃমাছ (ব্রুড) সংগ্রহ করে। সেই ব্রুড থেকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত এই হ্যাচারীতে এবছর দেশে প্রথমবারের মত ভিয়েতনাম হোয়ায়েট মাসল পাঙ্গাসের সফল কৃত্রিম প্রজনন করে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় বিশ লক্ষ পোনা।
মাৎস্যবিজ্ঞানে ¯œাতক স্বর্ণলতার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আব্দুল কাদির তরফদার জানান যে, আমাদের দেশে এতদিন ধরে উৎপাদিত থাই পাঙ্গাস রপ্তানী বাজারে প্রবেশ করতে না পারলেও ভিয়েতনামের নতুন জাতের এই পাঙ্গসের পক্ষে রপ্তানী বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মাছের মাংসের রং কে তিনি প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেন। থাই পাঙ্গাসের মাংসের রং লাল হলেও ভিয়েতনাম জাতের পাঙ্গসের মাংস সাদা। ফালে আমেরিকা-ইউরোপের বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। একারণে ভিয়েতনাম প্রতি বছর শুধু পাঙ্গাস রপ্তানী করেই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জণ করে।
নতুন জাতের এই পাঙ্গসের বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর ড. হারুনুর রশীদ বলেন, মাংসের রঙের কারণে রপ্তানী বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের বাজারেও এই পাঙ্গাসের ভাল চাহিদা থাকবে। এছাড়া থাই পাঙ্গাসের তুলনায় এফ.সি.আর. বেশ কম হওয়ায় উৎপাদন খরচ অনেক কম হবে, ফলে মাছ চাষী অধিক লাভবান হবে।
ড. হারুন আরো বলেন, পাঙ্গাস মাছের দাম অন্য মাছের তুলনায় কম। এতে পাঙ্গাস মাছের উৎপাদন যাতে নিরুৎসাহিত না হয় সেদিকে সবার দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এ মাছ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ফ্রোজেন ফুড হিসেবে ব্যাপকভাবে রপ্তানি করা যায় কি না তার সম্ভাব্যতাও খতিয়ে দেখা দরকার। সবার অজান্তেই দেশে পাঙ্গাস চাষের এক যাত্রা সূচিত হয়েছে এবং আশা করা যায়, পরবর্তীতে তা আরো বেগবান হবে। সে জন্য দরকার হবে পাঙ্গাস চাষিদের সচেতন করা এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ মাছের চাষ পদ্ধতি ও জাতের উন্নয়নের জন্য গবেষণা কার্যক্রমও চালিয়ে যেতে হবে। আশা করা যায়, পাঙ্গাস মাছ দেশের মানুষের আমিষের ঘাটতি পূরণ করার পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরো বেশি অবদান রাখবে।
————————————–
লেখকঃ
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২।

Comments